ইন্ডিয়ার সব টিভি চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল, পত্রিকার পক্ষে যা সম্ভব হয়নি; সেটা সম্ভব হয়েছে নেটফ্লিক্সের চার পর্বের ডকুমেন্টরি ‘The Romantics’ এর বদান্যতায়। ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন হাউজের কর্ণধার, ডিরেক্টর, প্রোডিউসার আদিত্য চোপড়ার ইন্টারভিউ।
একটা মানুষ তার সবশেষ ইন্টারভিউ দিয়েছেন প্রায় ২০ বছর আগে। এরপরে কোনদিন তিনি আর ক্যামেরার সামনে আসেননি, নিজের সিনেমার প্রমোশনে তিনি নেই, কোন পার্টিতে নেই, কোত্থাও নেই।
এরপরেও তিনি আছেন তার নাম দিয়ে, তার প্রোডাকশন হাউজ দিয়ে। নিজে সিনেমা বানালেও আছেন, অন্যের সিনেমা বানাতে হেল্প করতে হলেও তিনি আছেন- তবে অবশ্যই পর্দার আড়ালে।
কমার্শিয়াল ভাবনা
সারপ্রাইজিংলি, আদিত্য চোপড়া ক্যামেরার সামনে খুবই স্পন্টেনিয়াস। ভীষণ ভাল্লাগছিল তাকে শুনতে। একটানা কথা বলে গেলেন, প্রতিটা শব্দ গোছানো। কমার্শিয়াল সিনেমা ব্যাপারে একটা মানুষের আন্ডারস্ট্যান্ডিং কতটা ভালো হতে পারে তিনি তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।

আদিত্য চোপড়া যুবক বয়সে শুধু ইংরেজি গান শুনতেন, আর ইংরেজি সিনেমা দেখতেন। যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে নিজের দেশেই সিনেমা বানাবেন, একদিনের মাথায় সব ইংরেজি রেকর্ড ছুঁড়ে ফেলে মাতৃভাষার গানের যা পেয়েছেন কেনা শুরু করে শুনতে লাগলেন।
কারণ যে ভাষায় সিনেমা বানাবেন, সেই ভাষার সাথে আর সেই ভাষার মানুষের সাথে কানেকশন দরকার সবার আগে।
অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। যশ চোপড়া যেখানে সিনেমার স্ক্রিপ্ট উর্দুতে লিখতেন, আদিত্য চোপড়া সেখানে ইংরেজিতে স্ক্রিপ্ট লিখতেন। মাল্টিপল টেকস নিতেন, যেখানে তার বাবা এক টেকে ওকে হলে আর কিছুই করতেন না।
নিজের মনের কথা শুনেছেন সবসময়ই, ভুল হলেও। তার কথা শুনেই পরিচালক সুরাজ বারজাতিয়া ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ থেকে কয়েকটা গান ফেলে দেন, ফলাফল- সিনেমার বিশাল ব্যবসাসফল হওয়া।
‘লামহে’ বানানোর সময়ই তার মনে হচ্ছিল, এই সিনেমা বক্স অফিসে ভালো করবে না। আসলেও করেনি।
NRI অডিয়েন্স
আদিত্য চোপড়ার যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, নিজের সময়কে বোঝা, অডিয়েন্সের পালস বোঝা। ইস্টের সাথে ওয়েস্টের ফিউশন আর তার মাধ্যমে নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান বা এনআরআই দর্শকদের মার্কেট ধরা।
আবার যখন সময় বদলেছে তখন তিনি হার্টল্যান্ড ইন্ডিয়ায় সিনেমার শুটিং করেছেন, গল্প সেখানে ফেঁদেছেন, সুইজারল্যান্ডের গানের শুটিং থেকে ফিরে এসেছেন। এছাড়াও তার রয়েছে অসাধারণ দূরদর্শিতা।
DDLJ আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর সেই টাকা দিয়ে চাইলে আরও অনেক গাড়ি, বাড়ি করতে পারতেন। অথচ নিজের বাবার কাছে তিনি চাইলেন, একটা ফিল্ম স্টুডিও করবেন।
নিজের পরিচালিত ‘বেফিকরে’ সিনেমার ব্যর্থতা, নিজের ভাই উদয় চোপড়াকে শত চেষ্টা করেও স্টার না বানাতে পারার ব্যর্থতা সবকিছুই চমৎকারভাবে মেনে নিয়েছেন আর কোন রাখঢাক না করেই স্বীকার করেছেন।
দিনশেষে আল্টিমেটলি পাবলিক যাকে স্ক্রিনে দেখতে চাইবে, তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না, সেই ব্যাপারটা বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছেন।
All About Films
একটি জিনিস পরিষ্কারভাবে এই ডকুমেন্টারি থেকে বোঝা গেছে, দ্য ম্যান আদিত্য চোপড়া ইজ অল এবাউট ফিল্মস। কম বয়সে নিজের ডায়েরিতে তিনি প্রতিটা মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার রিলিজ ডেট থেকে শুরু করে বক্স অফিস কালেকশন সব লিখে রাখতেন, আর এখন সব সিনেমা হলে গিয়ে লুকিয়ে দেখেন।
কোন সিনে দর্শকের রিঅ্যাকশন কেমন, সে ব্যাপারে থাকে তার শ্যেনদৃষ্টি। আরেকটা ব্যাপার ভীষণ ভালো লেগেছে, নিজের প্রথম সিনেমা যখন ১০টি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড পেলো, সেই এওয়ার্ড গ্রহণ করার পর থেকে আদিত্য চোপড়া আর কখনও কোন এওয়ার্ড প্রোগ্রামে যাননি।
‘আমি কয়টা এওয়ার্ড পেলাম, সে কয়টা এওয়ার্ডস পেলো?’ – এই নাম্বার গেমে নিজেকে আটকে ফেলেননি তিনি।
শেষ করছি আদিত্য চোপড়ার বলা একটি লাইন দিয়েই- ‘For a film making family, your only identity is your FILM.’

পুনশ্চ- ১৯৭৬ সালে যশ চোপড়া পরিচালিত কাভি কাভি সিনেমাটি সম্ভবত প্রথম হিন্দি সিনেমা যা কিনা লস এঞ্জেলসের কোন সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল। এরপর থেকেই যশ চোপড়ার সিনেমাগুলোর জয়রথ শুরু হয়।
লস এঞ্জেলসে বসবাসকারী একজন ইন্ডিয়ান ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন, যার নাম ছিল জাগমোন মুন্ধারা। এই ব্যক্তির নিজস্ব একটি থিয়েটারও ছিল যেখানে কাভি কাভি রিলিজ পেয়েছিল।
জাগমোন মুন্ধারার মেয়ে স্মৃতি মুন্ধারা নেটফ্লিক্সের এই চার পর্বের ডকুমেন্টারি The Romantics বানিয়েছেন।
হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। সময় সম্ভবত এভাবেই ফিরে আসে!